আমার যৎকিঞ্চিৎ ভূগোল-বিদ্যা ভাবনার নহরে বহর করে উঠতে পারে না পুরোপুরি। উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত ভূগোল বইটি পাঠ্যবইয়ের তালিকায় ছিল, বহুদিন পরে এসে আজ বুঝতে পারি সে শুধু ওজনই বাড়িয়েছিল বইয়ের ব্যাগের, জ্ঞানের ওজন বাড়ায়নি খুব একটা। আহ্নিক গতি, বার্ষিক গতি, জোয়ার-ভাটা, তেজ কাটাল, মরা কাটাল- এ সবই ছিল সিলেবাসে। পরীক্ষায় পাশের জন্য রাত জেগে কখনও ইউরোপের শিল্প, উত্তর আমেরিকার খনিজ, দক্ষিণ আমেরিকার কৃষি, আবার কখনও বা অস্ট্রেলিয়ার প্রাণী নিয়ে লেখা মোটা মোটা বইয়ের পাতার পার পাতা গলাধঃকরণ করেছি, আর টু দ্য পয়েন্টে সেগুলো উগরে দিয়েছি পরীক্ষার খাতায়, মাষ্টারসাহেবরাও যারপরনাই খুশি হয়ে নম্বরের বন্যা বইয়ে দিয়েছেন খাতার কোণায়। কিন্তু বাস্তব জীবনে সেগুলো প্রয়োগ করা তো দূরের কথা, প্রয়োগ যে করা যায় সেটাই ভাবিনি কখনো। সোজা কথায়, সার্টিফিকেট লাভের জন্য ‘পড়তে হয়েছে বিস্তর, বুঝতে হয়েছে অল্প’।
আমার সেই সীমিত ভূগোল-বিদ্যা আমাকে বলে না, আগ্রাসী মানুষের চোখ এড়িয়ে সাত সাগর আর তের নদীর ওপারে কোন ছোট্ট একটা দ্বীপরাষ্ট্র, কিংবা প্রভুরাষ্ট্রগুলোর স্যাটেলাইটের নজরদারির বাইরে একখণ্ড সমতল জমিন এমন কোথাও আছে কি না, যেখানে বহুদিন আগে একবার রাত নেমেছিল, তারপর আর কোনদিন ভোর হয়নি, সূর্য সেখানে এক প্রতারণার নাম, আহ্নিক গতি সেখানে পরাভূত হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে ধ্যানমগ্ন একপেয়ে বকের মতো, একটা পাখিও ভুল করে ডেকে ওঠে না সেখানে মাঝরাত্তিরে, গেয়ে ওঠে না কখনো ঘুম ভাঙানোর গান।
তবে হ্যাঁ, ভূগোল না বললেও ইতিহাস বলে। ইতিহাস আমাকে বলে একথা- এখানে, এই দেশে, আজ থেকে কিছু বছর আগে, একটা রাত নেমে এসেছিল। গাঢ় অন্ধকার ছিল তা, ছিল দীর্ঘ, যদিও দীর্ঘশ্বাসের মতো অতটা ছোট নয়। বরং এতটা দীর্ঘ যে এখনও বয়ে চলেছে সে রাত, বড্ড একাকী, ভীষণ রকমের নিঃসঙ্গতার চাদরে মোড়া। জানা নেই কভু শেষ হবে কি না তা। পৌরনীতি বলে, কেউ কেউ এখনও ব্যথাতুর নয়নে প্রতীক্ষার প্রহর গুনছে, সূর্য উঠবে অয়নে এক সময় চোখ ডলতে ডলতে, আসবে রাঙা ভোর।
সেই রাতের কথা বলি। সাভার জেলা-অন্তর্গত পলাশবাড়ী, বাইপাইল। ১০ এপ্রিল, ২০০৫ দিবাগত রাত ১:০০ টার দিকে সেখানে স্পেকট্রাম সোয়েটার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড নামের একটা ফ্যাক্টরির নয়তলা ভবন ধ্বসে পড়েছিল। এ ঘটনায় কাগজে-কলমে ৬২ জন শ্রমিক নিহত হয়েছিল, আহত হয়েছিল অনেকে। আমি নিঃসন্দেহে ভীষণ রকমের সৌভাগ্যবান। আমি তাদেরই একজন, যারা সে-রাতে দুর্ঘটনার সময় ঐ কারখানায় ছিল এবং জীবন নিয়ে বেরিয়ে আসতে পেরেছিল সেই মৃত্যুকূপ থেকে। খুব সামান্য শারীরিক আঘাত পেয়েছিলাম সেদিন। কিন্তু যে মানসিক আঘাত আমি পেয়েছিলাম, তা বর্ণনা করার ভাষা আমার জানা নেই। কারণ, ভাষা-সাহিত্যেও আমার দখল তথৈবচ।
সেই ভয়াল, নিষ্ঠুর নরকরাত্রির বিভীষিকাময় স্মৃতি আজও ছায়া ফেলে আমার মনের আয়নায়। আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায় শিকারী নেকড়ের মতো। আমি ভীত হরিণের মতো ছুটে চলি বাতাসের ডানায় ভর করে। এপ্রিল এলেই আমার দু’চোখ আজও হয়ে ওঠে কৃষ্ণচূড়া। বহু সহকর্মী হারানোর অসহ্য স্মৃতি আমাকে বার বার টেনে নিয়ে যায় সেই দিনগুলোতে, আমার ইচ্ছের একান্তই বিপ্রতীপে।
পাশাপাশি দু’টো প্রতিষ্ঠান ছিল সেখানে। শাহরিয়ার ফেব্রিক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড আর স্পেকট্রাম সোয়েটার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। একই কর্ত্তৃপক্ষ চালাতেন কারখানা দু’টো, বলতে গেলে একই ভবনে, একই ছাদের নিচে।
আমি চাকরি করতাম শাহরিয়ার ফেব্রিক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডে, ডাইং ইউনিটে। সেরাতে ভবন ধ্বসে মূলত ক্ষতিগ্রস্ত হয় ডাইং ইউনিটের পূর্বদিকে বর্ধিত বহুতল অংশ, যেখানে ছিল নিটিং এবং সোয়েটার ইউনিট। ডাইং ইউনিটও ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তবে তার পরিমাণ ছিল নিটিং এবং সোয়েটার ইউনিটের তুলনায় অনেকটাই কম। ডাইং ইউনিটের যে অংশটা অক্ষত ছিল, সৌভাগ্যক্রমে দুর্ঘটনার সময় সেখানেই ছিলাম আমি। সৃষ্টিকর্তার এ যেন এক অমোঘ নির্ধারণ, এক অপার কৃপায় নতুন জীবন দান!
নিটিং সেকশনে তখন প্রধান হিসাবে চাকরি করতেন বুখারী স্যার। উনি টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার, ছিলেন ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার হিসাবে। ঐ সেকশনে আর একজন টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার ছিল, আমাদের জুনিয়র, মামুন নাম করে। ডাইং সেকশনে টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার ছিলাম তখন আমরা চারজন। জাহাঙ্গীর স্যার ছিলেন জেনারেল ম্যানেজার, মাসুদ স্যার ছিলেন ম্যানেজার। বন্ধু শিমুল আর আমি, দু’জন ছিলাম ডাইং ইউনিটের সিনিয়র প্রডাকশন ইঞ্জিনিয়ার। এতক্ষণ যাদের কথা বললাম, আমরা শেষের দু’জন বাদে আর সকলেই তখন জেনারেল শিফট ডিউটি করেন, সকাল ন’টা থেকে সন্ধ্যা ছ’টা কিংবা সাতটা পর্যন্ত ফ্যাক্টরিতে থাকেন, তারপর বাসায় চলে যান। বন্ধু শিমুল আর আমি, আমরা দু’জন সূর্য এবং চন্দ্রের মতো, একজন দিনে উঠলে আর একজন রাতে। শিমুল দিনের পালায় ডিউটি করলে আমি করি রাতের পালায়, আমি দিনে ফ্যাক্টরিতে থাকলে শিমুল থাকে রাতে। এক সপ্তাহ পর পর আমাদের দু’জনের শিফ্ট বদল হয়।
১০ এপ্রিল, ২০০৫। আমার মনে পড়ে সেদিন সন্ধ্যায় উত্তরের আকাশ কালো করে বেশ মেঘ উঠেছিল। মনে হচ্ছিল আকাশ কাঁপিয়ে ঝড় উঠবে যেকোন সময়। উঠেও ছিল এক সময়। দমকা বাতাস ধূলো উড়াল কিছুক্ষণ, সেই সাথে উড়িয়ে নিয়ে গেল কালো মেঘ দক্ষিণ আকাশে। বৃষ্টির জন্য হাহুতাশ ছিল, কিন্তু আকাশের মন গলল না। সেদিন দিনের বেলা ডিউটি ছিল শিমুলের। রাত আটটা বাজার কিছুক্ষণ আগে আমি ফ্যাক্টরিতে ঢুকলাম, সারা রাতের জন্য। প্রাত্যহিক রুটিন অনুযায়ী শিমুলের কাছ থেকে রাতের কর্তব্যসমূহ বুঝে নিলাম। তারপর বন্ধু বেরিয়ে গেল ফ্যাক্টরী থেকে। তখনও কি জানতাম, কয়েক ঘণ্টা বাদে কি এক অমানিশা গ্রাস করতে চলেছে আমাদের সবাইকে!
কত কথাই না পড়ছে আজ লিখতে বসে! ক’দিন বাদে ছিল পহেলা বৈশাখ। ফ্যাক্টরি কর্ত্তৃপক্ষ সে-বার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বৈশাখের প্রথম দিন ফ্যাক্টরিতে বিশেষ খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন করা হবে, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হবে কারখানার সকল শ্রমিক-কর্মচারী-কর্মকর্তার অংশগ্রহণে, সব শেষে থাকবে বিশেষ র্যা ফল ড্র। ক’দিন ধরে তাই ফ্যাক্টরিতে ছিল বেশ একটা উৎসবের রেশ। দিনে বার ঘণ্টা, চৌদ্দ ঘণ্টা কিংবা ষোল ঘণ্টা অমানুষিক শ্রমে কাহিল মানুষগুলোর মুখ তাই হাসি হাসি সব সময়। অনুষ্ঠানের টিকিট বিক্রি চলছে, খুব তো আর দেরী নেই, মাঝখানে মাত্র তিনটি দিন। প্রতিদিনের মতো সেদিন রাত দশটার দিকে ফ্যাক্টরীর গেটে চা খেতে বসে মিনিট দশেকের একটা ছোট-খাটো আড্ডা হয়েছিল যে সকল ঘনিষ্ট সহকর্মী রাতের পালায় কর্মরত ছিলেন তাদেরকে নিয়ে। আসন্ন বর্ষবরণ অনুষ্ঠান নিয়ে কার কি ভাবনা, র্যা ফল ড্র’তে কি কি পুরস্কার থাকছে, পুরস্কার প্রাপ্তিতে কার ভাগ্য কতটা প্রসন্ন, কে কতটা অভাগা-অপয়া তা নিয়েও চলছিল বিস্তর পর্যালোচনা। কিছুটা সময় গল্প-গুজবে উড়িয়ে ফিরে এসেছিলাম কাজে।
রাতের বেলা যারা বেসরকারী কারখানায় রেসপন্সিবল অফিসার হিসাবে কর্মরত থাকেন, তারা বসার অবসর খুব কমই পান। সে-রাতে ফ্যাক্টরী গেট থেকে সেই যে চা খেয়ে ভিতরে ঢুকেছিলাম, মনে আছে, একটুও বসতে পারিনি। এক নাগাড়ে ঘণ্টা তিনেক কাজ করলাম এক মনে। এক সময় ঘড়িতে দেখলাম রাত পৌনে একটার মতো বাজে। চৈত্রের গরম রাতে ফ্যাক্টরীর মধ্যে চল্লিশ ডিগ্রীরও বেশি তাপে শরীরটা তেতে উঠেছিল ভীষণ। ক্লান্তি আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল বলে ওয়াসরুমে গেলাম, চোখে-মুখে পানি ছিটালাম কিছুক্ষণ। ওয়াসরুমটা ছিল ফ্যাক্টরির পূর্বাংশে, ঠিক তার পাশেই ছিল নিচু বিস্তীর্ণ জলাভূমি। ফ্যাক্টরি থেকে একটু দূরে, আরও একটু পূবে, জলাভূমির উপরেই মাটি ফেলে উঁচু করে একটা অস্থায়ী শেড তৈরি করা হয়েছিল, যেটাকে রাতের বেলা দেখতে লাগত চারিদিক জলঘেরা একটা বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো। ব্যবহারের পর নিঃশেষিত ড্রাম, ঝুট-কাপড় ইত্যাদি গাদা করে রাখা হতো সেই দ্বীপের মতো জায়গাটায়। ওয়াসরুমের সামনে থেকে একটা কাঠের সাঁকো গিয়ে মিশেছে ঐ দ্বীপে, এটাই একমাত্র রাস্তা ওখানে যাওয়ার। ওয়াসরুম থেকে বের হয়ে ঐ সাঁকোটার উপর গিয়ে দাঁড়ালাম। ঝিরিঝিরি দক্ষিণা বাতাস গায়ে লাগছিল, একটু একটু করে শীতল হচ্ছিল পোড়া বুকটা। দূরে-প্রান্তরে তাকালে বোঝা যাচ্ছিল এখনও খানিকটা চাঁদ রয়েছে আকাশে, ঢলে পড়েছে পশ্চিমে, ফ্যাক্টরির বহুতল ভবনের আড়ালে। দৃশ্যমান অর্ধেক আকাশে ছিল অজস্র তারা বোনা। পেশাদারিত্বর আবরণ ভেদ করে জেগে উঠতে চাইছিল ব্যক্তিসত্ত্বা, কারণ তখনও কর্মজীবনের সাথে পুরোপুরি আপোস হয়ে ওঠেনি। কিছু পুরোনো স্মৃতি, কিছু ফেলে আসা মুখ জায়গা করে নিচ্ছিল ক্ষণে ক্ষণে, বোনা তারার ফাঁকে ফাঁকে, শুকতারা-ধ্রুবতারার মতো।
মিনিট দশেক সাঁকোর উপর থাকার পরে চলে এলাম আবার ফ্যাক্টরীর ভিতরে। তখন ঘড়িতে একটা পাঁচ-দশ বাজে। রাত জাগলে ক্ষিধে পায় বেশি, যাদের রাত জেগে কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে তারা জানবেন। এতক্ষণে কাজের ভিতরে ডুবে ছিলাম, তাই টের পাইনি। চোখে-মুখে পানি দেওয়াতেই যেন পেটের ভিতর ক্ষুধাটা ফোঁস করে উঠল। প্রতিদিনের মতো সন্ধ্যারাতে সাঈদ নামে এক মেশিন অপারেটরকে দিয়ে দোকান থেকে রাতের জন্য টিফিন বিস্কুট-কলা আনিয়েছিলাম। সেটা হাতে নিয়ে বসেছি, খাওয়া সবে শুরু করব, এমন সময় প্রচণ্ড একটা শব্দ হলো। কয়েকটা মাত্র ইমার্জেন্সি লাইট ছিল, সেগুলো জ্বলে উঠল একটার পর একটা, কয়েকবার দপদপ করে। যান্ত্রিক শব্দে এতক্ষণ কান পাতা যাচ্ছিল না, সহসা সব শব্দ থেমে গেল, তার বদলে গ্রাস করল একরাশ ভুতুড়ে নিস্তব্ধতা। মনে হলো আমার কানে তালা লেগে রয়েছে। আমি পড়িমড়ি করে বের হয়ে আসলাম যে ঘরে খেতে বসেছিলাম সেখান থেকে। বের হতে গিয়ে বোধ হয় কোথাও আঘাত পেয়েছিলাম, শার্ট ছিড়ল, মুহূর্তেই বুকের উপর কিছুটা জায়গা রক্তে ভিজল। একটু এগোতেই ধেয়ে এলো ধূলোঝড়ের মতো কিছু একটা, নিঃশ্বাস বন্ধ হওয়ার যোগাড় হলো। এর মধ্যেই নাকে এসে লাগল একটা অন্য রকম গন্ধ, একদম অপরিচিত তা। কিছু মানুষের ভয়ার্ত চিৎকার ভেসে এলো কানে। দৌড়ে গেলাম সেদিকে। কিছু মানুষকে বলতে শুনলাম বয়লার বিষ্ফোরিত হয়েছে। আলো-আঁধারিতে সেদিকে যেতেই দেখলাম একজন আহত শ্রমিককে পাঁজাকোলা করে নিয়ে আসছে কয়েকজন শ্রমিক। তখনও ধারণাই করতে পারিনি আসলে কি ঘটেছে। আরও একটু এগোতেই বুঝতে পারলাম পূর্বদিকে এগোনোর পথ শেষ হয়ে এসেছে আকস্মিকভাবে, অপ্রত্যাশিতভাবে নিচে নেমে এসেছে সিলিং, ঠেকেছে মেঝেতে, কংক্রীটের জঙ্গল ছড়িয়ে ছিটিয়ে পথ আগলে রেখেছে তারা।
আমি উল্টো দিকে দৌড়ে মেইনগেটে চলে এলাম। আমার সাথে আরও অনেকে। সবাই দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য। ফ্যাক্টরীর মেইনগেট বন্ধ ছিল। সিকিউরিটিকে বুঝিয়ে বলার পরে গেট খুলে দিলেন। আমরা ফ্যাক্টরির বাইরে এসে বাইপাইল-নবীনগর রাস্তার উপর দাঁড়ালাম। সিকিউরিটির সাথে টর্চ মারতে মারতে গেলাম ফ্যাক্টরির বাইরে দক্ষিণ পাশ দিয়ে, পূর্ব দিকে। যেটা নিজের চোখে দেখলাম সেটা বিশ্বাস করতেও কষ্ট হচ্ছিল। নয়তলা বিল্ডিং এর পুরোটা ধ্বসে পড়েছে, এখন সেটাকে মনে হচ্ছে বড়জোর দু’-তিনতলার সমান উঁচু, ফ্লোরগুলো একটার পর একটা পড়ে রয়েছে স্যাণ্ডউইচের রুটির মতো। সিকিউরিটিরা জানালেন ল্যাণ্ডফোনের লাইন বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। তাদের কাছ থেকে নাম্বার নিয়ে ম্যানেজিং ডাইরেক্টর স্যারের সাথে কথা বললাম আমি, মোবাইল ফোনে। আমি ছাড়া কথা বলার মতো পদস্থ কেউ ছিলও না তখন। নিজের পরিচয় দিয়ে বললাম সবকিছু, সবিস্তারে। সব শুনে তিনি বললেন, ‘দেখছি।’ পরবর্তীতে সম্ভবত তিনিই ফায়ার সার্ভিসে ফোন দিয়েছিলেন, হাসপাতালে ফোন দিয়েছিলেন অ্যাম্বুলেন্স পাঠানোর জন্য।
এরপর আমি একে একে ফোন দিলাম আমার উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে, সবাইকে জানালাম কি ঘটেছে এদিকে। ততক্ষণে অনেক আহত শ্রমিককে ফ্যাক্টরির ভিতর থেকে টেনে এনে জড়ো করা হয়েছে রাস্তার পাশে। যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে তারা। আমরা বাইপাইল-নবীনগর রাস্তায় দাঁড়িয়ে চলমান গাড়ি দাঁড় করিয়ে করিয়ে তুলে দিতে লাগলাম আহত শ্রমিকদের, নিকটস্থ হাসপাতালের উদ্দেশ্যে, চিকিৎসার জন্য। তাদের সাথে পাঠিয়ে দিচ্ছিলাম কিছু সুস্থ্য শ্রমিক, আহতদের পাশে থাকার জন্য, দরকারী সেবা শশ্রুষার জন্য।
একটু বাদে আশেপাশের এলাকা থেকে মানুষ-জন আসতে শুরু করল দলে দলে। শুরু করল উদ্ধার অভিযান। আরও কিছু বাদে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি এলো। অন্য আর দশটা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে যা হয় তাই হলো। ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি বিল্ডিং এর খুব কাছে পৌঁছাতে পারছে না। দূর থেকে সার্চ লাইটের আলো ফেলল তারা। সে আলোয় মনে হলো যেন দু’তিন তলা সমান উঁচু সিমেন্ট, রড আর ইটের একটা পাহাড় শুয়ে রয়েছে, একটার পর একটা পড়ে থাকা ছাদ যেন সিঁড়ির এক একটা ধাপ, যা বেয়ে খুব সহজে উঠে পড়া যাবে সেই পাহাড়ের চূড়ায়।
আরও একটু এগিয়ে গেলাম, ফ্যাক্টরির দক্ষিণ পাশ দিয়ে, আরও একটু পূবে, যেদিকে নিচু জলাভূমি ছিল, বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো জায়গাটা ছিল, কাঠের সাঁকোটা ছিল, যেখানে দুর্ঘটনার মিনিট দশেক আগে আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম। ফায়ার সার্ভিস টিমের সার্চ লাইটে ভীষণ অবাক হয়ে দেখলাম, সেই জায়গাটার কোন অস্তিত্বই নেই এখন আর। যেন একটা ভূমিকম্প চোখের পলকে পুরো এলাকার মানচিত্র পাল্টে দিয়েছে। যেখানে সাঁকোটা ছিল সেই জায়গাটা এখন ধ্বসে পড়া নয়তলা ভবনের একেবারে নিচে। চাঁদ কি ডুবেছে তখন? সার্চ লাইটের চোখ ধাঁধানো আলো থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে টের পেলাম না তারাদের অস্তিত্বও। আমি আসলে ঝাপসা চোখে সৃষ্টিকর্তাকে খুঁজছিলাম, একটু কৃতজ্ঞতা জানাব বলে। মনে মনে বলছিলাম বার বার, ‘হে সর্বশক্তিমান, তুমি আমাকে মৃত্যুর কোল থেকে ফিরিয়ে এনেছো। এ আমার নতুন জীবন। এ আমার পুনর্জন্ম!’
আবার ফিরে এলাম ফ্যাক্টরির মেইনগেটে, নবীনগর-বাইপাইল রাস্তার উপরে। আমার শিফটে চাকরি করতেন জয়নাল সাহেব। দুর্ঘটনার আগে তিনি দেখেছিলেন আমাকে পূর্বদিকের ওয়াসরুমে যেতে, কিন্তু ফিরে আসতে দেখেননি। তিনি ধরেই নিয়েছিলেন, আমি ধ্বসে পড়া ভবনের নিচে চাপা পড়েছি। অনেককে তিনি জিজ্ঞাসা করছিলেন আমার কথা। যদিও কেউ কেউ তাকে আশ্বস্ত করেছিল যে আমি বাইরে আছি, ভালো আছি, তিনি তা বিশ্বাস করছিলেন না। আমাকে দেখেই তিনি নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারালেন, আমাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার উপায় খুঁজে না পেয়ে আমিও ডুকরে কেঁদে উঠলাম।
এদিকে নানা দিক দিয়ে উদ্ধার অভিযান চলছে। যারা ঘটনার আকস্মিকতায় বিমূঢ় হয়ে জীবন নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এসেছিল দুর্ঘটনার পরপরই, তারা আবার ঢুকছে ভিতরে প্রিয় সহকর্মীকে বাইরে না পেয়ে, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। ফায়ার সার্ভিসের আরও টিম আসছে। যারা ইতিমধ্যে এসেছেন তারা কাজে হাত লাগিয়েছেন। হাত লাগিয়েছেন স্থানীয় অধিবাসীরা। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, এ ধরণের বিপর্যয়ে উদ্ধার কার্যক্রম চালানোর জন্য যে ধরণের ভারী ইকুইপমেন্ট দরকার তার কিছুই উদ্ধারকর্মীদের কাছে নেই। অগত্যা হালকা যন্ত্রপাতি দিয়েই চালানো হচ্ছে উদ্ধার অভিযান। ভিতর দিয়ে, বাইরে দিয়ে। দেয়াল কেটে মানুষ বের করা হচ্ছে। কখনো বের করা হচ্ছে জানালা ভেঙে। কখনো পুরু কংক্রীটের আস্তরণ কেটে।
এক ফাঁকে বন্ধু শিমুলকে ফোন দিলাম। কাছেপিঠে থাকত, চলে এলো ফোন পেয়েই। সাথে এলো অন্যান্য বন্ধুরাও। সবাই টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার। তখন ওরা বেশ কয়েকজন বন্ধু মিলে মেসের মতো করে থাকে একটা ফ্ল্যাট নিয়ে, পল্লীবিদ্যুতের উল্টোপাশে কাঁঠালবাগান বলে একটা জায়গায়, আর চাকরি করে আশেপাশের বিভিন্ন ফ্যাক্টরিতে।
একটা বেসরকারি টিভি চ্যানেল এসে হাজির হলো রাত তিনটের দিকে। এসেই উপস্থিত মানুষকে নানা প্রশ্নবানে জর্জরিত করতে লাগল। ভবনের অপরিকল্পিত সম্প্রসারণের ব্যাপারটা কিছু মানুষের মনে ক্ষোভের সঞ্চার করছিল। মিডিয়া যেন তাতেই ঘি ঢালল। ততক্ষণে এলাকার মানুষজন যার যার মতো করে জীবনহানির সংখ্যা নিরুপণ করা শুরু করে দিয়েছে। কারো ধারণা শ’পাঁচেক মানুষ মারা যাবে। কারো ধারণা এ সংখ্যা হাজার ছাড়াবে। কেউ শিউরে উঠে বলছিল, যদি দুর্ঘটনাটা আরও এক ঘণ্টা আগে ঘটত তাহলে তিন হাজার মানুষ মারা যেত। কারণ, তখন সোয়েটার ইউনিট চলছিল, ঐ ইউনিট ছুটি হয়ে গিয়েছিল রাত বারোটায়।
ভাবছিলাম। আর এলোমেলো পায়ে হাঁটছিলাম পাগলের মতো। একবার এদিক থেকে ওদিকে, আবার ওদিক থেকে এদিকে। মাথায় ঢুকছিল না কিছুই। কারো সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছিল না। একবার ইচ্ছে হচ্ছিল সব কিছু ফেলে হেঁটে দিই একদিকে, এ সব কিছু ছেড়ে-ছুড়ে অনেক দূরে কোথাও। আবার কিসের টানে যেন যেতেও পারছিলাম না। একবার ভাবলাম বাসায় চলে যাই, স্ত্রীকে সংবাদটা দিই গিয়ে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সিদ্ধান্ত বদলালাম। এত রাতে বাসায় যাওয়াটা ঠিক হবে না। তার চেয়ে বরং সে যেভাবে ঘুমিয়ে আছে সেভাবেই থাক। বেঁচে যেহেতু আছি সকাল হলে ধীরেসুস্থ্যে সংবাদ নিয়ে হাজির হলেই চলবে!
আর একটা ব্যাপার এতদিন পরে এসেও আমি যখন ভাবি, ভয়ে রীতিমতো শিউরে উঠি। আমার বিয়ে হয়েছিল ২০০৪ সালের ৩রা সেপ্টেম্বর। তখন আমি ছোট পোস্টে চাকরি করি, তাই বিয়ের পরপরই ঢাকায় সংসার পাততে পারি নি। অপেক্ষা করছিলাম কিছুটা গুছিয়ে নেওয়ার। গুছিয়ে নিতে নিতে কেটে গিয়েছিল অনেক দিন। ২০০৫ এর এপ্রিলের প্রথম দিন থেকে থাকব এই হিসেবে পল্লীবিদ্যুতের ওখানে দুই রুমের একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছিলাম। এপ্রিলের ৬ তারিখে আমার শ্বশুর তার মেয়েকে নিয়ে এলেন, সাথে আমার আব্বাও রয়েছেন। উদ্দেশ্য দু’বেয়াই মিলে আমাদের নতুন সংসার শুরু করে দিয়ে যাবেন। সম্ভবত তাঁরা দিন দুই আমার নতুন বাসায় থাকার পর যার যার বাড়ি ফিরে গিয়েছিলেন। তার ঠিক দু’দিন পরে, অর্থাৎ আমাদের নতুন সংসার শুরু করার চার দিনের দিনই ঘটেছিল ঐ স্পেকট্রাম ট্র্যাজেডি। এই ব্যাপারটাই এখনও মাঝে মাঝে আমার মনের ঘরে ঢুকে আমাকে ব্যথার সূচে এফোঁড়-ওফোঁড় করে দেয়। আতঙ্কিত হয়ে ভাবি, যদি সেরাতে আমার কিছু একটা হয়ে যেত কিভাবে সেই ধাক্কা কাটিয়ে উঠত আমার স্ত্রী? যে মেয়েটা এতদিনের চেনা পরিমণ্ডল ছেড়ে, এত এত আশা বুকে বেঁধে নতুন বাসা বুনতে এলো, এত বড় একটা ধাক্কার পরে কেমন হতো তার জীবনের অনাগত দিনগুলি? আমি ভেবে সারতে পারি না, মাঝপথে থমকে থাকি, বিষণ্নতা আমাকে নাস্তানাবুদ করে দেয়।
যা ঘটেনি, তা নিয়ে চিন্তা নাই বা করি। বরং যা ঘটেছিল সেরাতে সে কথাই বলি আরও কিছুক্ষণ।
দেখলাম কয়েকটা লাশ বের করা হয়েছে। তারমধ্যে বয়লার রুম থেকে বের করা হয়েছে পুড়ে কয়লা হয়ে যাওয়া একটা লাশ। সময় যত গড়াচ্ছে ততই আহত শ্রমিক বের হওয়ার হার বাড়ছে। একটু বাদে বাদে অ্যাম্বুলেন্স আসছে সাইরেন বাজিয়ে। তারপর আবার সাইরেন বাজিয়ে নিয়ে চলে যাচ্ছে মৃত আর অর্ধমৃত মানুষের দেহ, হাসপাতালের দিকে।
মনে পড়ে গেল, ধ্বসে পড়া ভবনের দোতলায় নিটিং সেকশন ছিল। ডায়িং সেকশনের মতো এই সেকশনটিও দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টা চলে, প্রতিদিনের মতো আজও চলছিল। শ’খানেক লোক কাজ করছিল সেখানে রাতের পালায়। অবস্থাদৃষ্টে আমার মনে হলো, তারা সবাই আটকে পড়েছে ধ্বসে পড়া ভবনের মধ্যে কোথাও সিমেন্টের জঙ্গলে।
নিটিং সেকশনের কথা মনে পড়তেই মনে পড়ে গেল রাকিবুলের কথা। নিটিং সেকশনের ইন চার্জ সে। বয়স চব্বিশ-পঁচিশ হবে, প্রায় আমাদেরই বয়সী। ভীষণ সদালাপী, সদা হাস্যময়, খুবই মিশুক প্রকৃতির। একটু বাদে বাদে পান খায় বলে উজ্জ্বল-শ্যামলা ঠোঁটজোড়া লালচে দেখায় সব সময়। কোথায় এখন সে? তার কথা মনে পড়তেই পকেট থেকে মোবাইল বের করে ফোন দিলাম। তার ফোন বন্ধ পেলাম। এক অজানা আশঙ্কা পথ করে নিল মনে ঢোকার। রাকিবুলের খুব ঘনিষ্ট কাকে যেন জিজ্ঞেস করতেই জানতে পারলাম রাকিবুলের সাথে তার কথা হয়েছে। ধ্বসে পড়া ভবনের কোন একটা জায়গায় সে আটকা পড়ে রয়েছে। সে তাকে বলেছে, ‘আমরা অনেক মানুষ এখানে। খুব অন্ধকার। কারো মুখ দেখতে পারি না। ছাদটা নিচে নাইম্যা আসতেছে। নিঃশ্বাস নিতে পারি না। খুব কষ্ট।’
আমি আবার ফোন দিলাম। শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে যন্ত্রটাকে ঠেসে ধরে রাখলাম কানের সাথে। কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করলাম, একবার আমার ফোনটা পৌঁছাক রাকিবুলের কাছে। আমার প্রার্থনা পৌঁছাল না সর্বশক্তিমানের দরবারে, আমার ফোনটাও তাই পৌঁছাল না রাকিবুলের কাছে। এখনও তার মোবাইল বন্ধ। হয়তো বিশেষ কিছু পাওয়ার আশা নেই, তারপরও পাগলের মতো দৌড়াতে লাগলাম ফ্যাক্টরীর দক্ষিণ পাশ দিয়ে। ধ্বসে পড়া ভবনের কাছে গিয়ে তাকিয়ে থাকলাম। পুরো বিল্ডিংটা এমন ভাবে ধ্বসে পড়েছে যে কিছুই বোঝার উপায় নেই কোনটা পাঁচতলা, কোনটা সাত তলা, কোথায় নিটিং সেকশন ছিল, কোথায় রাকিবুল কাজ করছিল, আর কোথায়ই বা সে এখন আটকা পড়ে রয়েছে।
আঁধার তরল হচ্ছিল একটু একটু করে। বোঝা যাচ্ছিল রাতের আর খুব একটা বাকি নেই। আমি বাইপাইল-নবীনগর রাস্তার পাশে উঁচু একটা ঢিবির মতো জায়গায় বসে রইলাম। সেখান থেকে দেখা যাচ্ছিল সব কিছুই। আহত শ্রমিকের আহাজারি, তাদের বুক ফাটা কান্না। তাদের কান্না দেখে তাদেরই সহকর্মীর চোখে বাঁধভাঙা জলপ্রপাত। মৃত্যুর দুয়ার থেকে কাউকে টেনে হিঁচড়ে বের করে এনে সমবেত কণ্ঠে ‘আল্লাহু আকবর’ ধ্বনি। একটু পরপরই সংবাদ আসছিল আমার কাছে। কে যেন এসে বললো, মেশিন অপারেটর কামালের আঙুল কেটে বের করা হয়েছে। কেউ একজন এসে বললো, দুই-তিনজন শ্রমিকের হাত এমন ভাবে কংক্রীটের নীচে পড়েছে যে হাত না কেটে ফেললে তাদেরকে বের করা সম্ভব না কোনমতেই। আমি শুনছিলাম সব কিছু, হয়তো দু’টো একটা কথাও বের হচ্ছিল আমার মুখ দিয়ে। কিন্তু সেগুলো আমার কথা নয়, স্রেফ কথার কথা। সত্যি বলতে কি কোন সংবাদই আমাকে স্পর্শ করছিল না তখন সে রকম ভাবে।
জানতাম রাকিবুলের একটা মেয়ে আছে। বছর পাঁচের মতো বয়স তার। প্রায়ই মেয়ের গল্প বলত আমার সাথে। যখন রাকিবুল দিনের পালায় ডিউটি করতে আসত তখন তার মেয়ে ঘুমিয়ে থাকত অধিকাংশ দিন। কিন্তু যখন রাতের পালায় ডিউটি থাকত তখন রাকিবুলের ফ্যাক্টরীতে আসার সময় তার মেয়েটি জেগে থাকত। বাবাকে ছাড়তে চাইত না, নরম হাতের মুঠি দিয়ে বাবার আঙুল টেনে ধরত। সেই মেয়েটি এখন ঘুমিয়ে আছে। এখনও জানে, বাবা আসবে ফিরে, সকাল হলেই। আমি মানসচক্ষে দেখতে পাচ্ছিলাম সেই নিষ্পাপ ঘুমন্ত মেয়েটিকে।
বুঝতে পারছিলাম, উদ্ধার কার্যক্রম চালানো বেশ কষ্টসাধ্যই হবে। এত ভারী সিলিং সরানো সম্ভব হবে না, ফায়ার সার্ভিসের অফিসার বললেন এমনটাই। একটার পর একটা ছাদ কেটে কেটে উপর থেকে নিচতলা পর্যন্ত আসতে হবে। আর তা করতে অন্তত দু’তিনদিন লাগবে। ততদিনে ক্ষুধা, তৃষ্ণা আর অক্সিজেনের অভাবে আটকে পড়া মানুষগুলো হয়ে যাবে লাশ। এক সময় দুর্গন্ধ ছুটতে শুরু করবে, বিকৃত হয়ে যাবে লাশগুলো, চেনা যাবে না কাউকেই তখন আর আলাদা করে। আরও পরে যে মৃতদেহগুলো পাওয়া যাবে সেগুলো হয়তো বেওয়ারিশ লাশ হিসাবে কবর দেওয়া হবে, লাশটাও পৌঁছাবে না প্রিয়জনের কাছে। অথবা পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা কংক্রীটের টুকরার সাথে গলিত-পচিত লাশখণ্ড, তাদের মাথার খুলি, হাড়-গোড় ছুড়ে ফেলে দেবে কোন ওয়েস্ট-ইয়ার্ডে, ক্ষুধার্ত শিয়াল-কুকুর মানুষের মাথার খুলি নিয়ে মারামারি করবে, উদ্ধার অভিযান সমাপ্তি ঘোষণা করা হবে শত মানুষের লাশের হিসাব গরমিল থাকা সত্ত্বেও।
রাকিবুলের মুখটাই ভেসে উঠছিল চোখের সামনে বারবার। আচ্ছা, গতকাল সন্ধ্যায় যখন রাকিবুল বাসা থেকে বের হয়েছিল ফ্যাক্টরীর উদ্দেশ্যে তখনও কি তার মেয়ে নরম মুঠি দিয়ে আঁকড়ে ধরেছিল তার হাত? ছোট্ট মেয়েটার লাউয়ের ডগার মতো চিকন হাতখানি হাতে নিয়ে কি বলে এসেছিল রাকিবুল তার মেয়েকে? ‘সকাল হলেই ফিরে আসব। সকাল হলেই ফিরে আসব, মা!’
নুনের ছিটা টের পাচ্ছিলাম রাতজাগা চোখে। পূবের আকাশটাতে লাল আভা ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে এরই মধ্যে, এ জন্যই হয়তো। আর একটু বাদেই মেঘহীন পূব আকাশ রাঙিয়ে সূর্য উঠবে, রচিত হবে সকাল ক্ষণকাল পরে এই ধরায়, আরও একটা রাত শামিল হবে প্রস্থানের মিছিলে। তবে এই রাতটা সংজ্ঞায়িত হবে বিভিন্নতার নিরিখে, ভিন্ন ভিন্ন বইয়ে- ভূগোল, ইতিহাস কিংবা পৌরনীতির পাতায়।